সমাজ সংস্কার আন্দোলনে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা

হ্যালো বন্ধুরা, আজকে আমরা সমাজ সংস্কার আন্দোলনে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা এই প্রশ্নের উত্তরটি আজকের এই পোস্টে বিস্তারিত আলোচনা করছি । ইতিহাসের এই প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং পরীক্ষাতে প্রায়ই এসে থাকে তাই প্রশ্নটি মন দিয়ে পড়ুন এবং বন্ধুদের সাথেও সেয়ায়র করুন ।

সমাজ সংস্কার আন্দোলনে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা

পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন ও সংস্কারের ফলে বাংলা তথা ভারতে সমাজ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি হয় । একদল প্রগতিশীল ভারতীয় পাশ্চাত্য ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যুক্তি ও মানবতাবাদের আলোকে দেশের ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার গুলিকে বিচার করতে চেয়েছিলেন । তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে কুসংস্কারাছন্ন ভারতীয় ধর্ম ও সমাজের সর্বাঙ্গিক সংস্কার সাধন প্রয়োজন । এই সংস্কার আন্দোলনে অন্যতম প্রধান পথিকৃৎ হলেন রাজা রামমোহন রায় ।

উনবিংশ শতকের ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন । রাজা রামমোহন রায় ১৭৭২ সালে মতান্তরে ১৭৭৪ সালে হুগলীর রাধানগর গ্রামে রক্ষনশীল ধনী পরিবারে রামমোহন এর জন্ম হয় । তৎকালীন ভারতের ক্ষমতাহীন মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর তাকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন । রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম এবং উপনিবেশিক শাসনব্যাবস্থার মধ্যে রামমোহন কে কাজ করতে হয়েছে, টা স্বত্বেও রামমোহন আজীবন সমাজ ও ধর্মের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে দেশবাসীকে সঠিক পথ নির্দেশ করতে প্রয়াসী ছিলেন । ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে ভারতবাসীকে চিন্তা জাগরণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা করে গেছেন । এইজন্য তাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভারত পথিক’ আখ্যা দিয়েছেন । জওহরলাল নেহেরুর দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন ভারতীয় জাতিয়তাবাদের জনক । আবার কারও কারও মতে রামমোহন ছিলেন ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ ।

রামমোহন এর মধ্যে ছিল চিন্তার সচ্ছতা, উদার দৃষ্টিভঙ্গি এবং যুক্তিবাদী মননশীল । ধর্ম ও সমাজের পূর্ণ বিন্যাসে তিনি ইসলাম যুক্তিবাদী ও খ্রিস্টধর্মের একেশ্বরবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । সেই সময় ভারতীয় সমাজ ছিল ধর্মভীতিত্তিক । সুতরাং ধর্ম সংস্কার ছাড়া সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়, এই কথা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন । বস্তুত রামমোহন রায় তাঁর উত্তরসূরি রামকৃষ্ণের মতো সর্ব ধর্মের মূলগত ঐক্যটি উপলব্ধি করেছিলেন । তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান বর্জিত নিরাকার ব্রহ্মের আরাধনায় হল হিন্দু ধর্মের প্রকৃত ও সৃষ্ট রুপ । আসলে রামমোহন সমাজ ও ধর্মকে আলাদা করে দেখেননি ।

১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে কিছু তরুণ অভিজাত নিয়ে আত্মিয় সভা প্রতিষ্ঠা করেন । এই সভার সাপ্তাহিক অধিবেশনে ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে যুক্তি ও তর্ক আলোচনা হত । দ্বারকানাথ ঠাকুর, কিশোর বসু, রামচন্দ্র বিদ্যাবাগিস প্রখুর সদস্যরা ছিলেন ।কিন্তু আত্মিয় সভা কার্যাবলীতে সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মসভা গঠন করেন । যেটি ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মসমাজে রুপান্তরিত হয় । ব্রহ্মস্মাজ বেদান্ত ভিত্তিক একেশ্বরবাদ প্রচার, নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা ইত্যাদির জন্য আলোচনা সভা ও জন্মগত গঠনের কাজ আত্মনিয়গ করে ।

ধর্ম সংস্কারের পাশাপাশি সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে রামমোহন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন । এর মধ্যে প্রধান হল সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে তাঁর সংস্কার প্রতিভা । এইকথা সত্য যে শ্রীরামপুরের মিশনারীরা প্রথমে এই অমানবিক প্রথার ওপরে প্রতিবাদ জানায় কিন্তু সংবাদপত্র কৌমুদি পত্রিকায় সতিদাহ প্রথার বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখে গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক কে প্রভাবিত করার কীর্তিত্ব রামমোহনের প্রাপ্য দিলীপ কুমার বিশ্বাস দেখিয়েছেন, সতীদাহের বিরুদ্ধে হিন্দু সমাজের মনে চেতনার সোচ্চার করা রামমোহনের প্রধান কৃতি । রামমোহনের অক্লান্তিক প্রচেষ্টা ছাড়া প্রবল রক্ষণশীল বিরোধী বেন্টিঙ্ক এর মুখে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সতীদাহকে নিসিদ্ধ করা সম্ভবপর হত না ।

ভারতীয় শাস্ত্রে অগাদ পণ্ডিত থাকলেও, ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি প্রজ্ঞাশীল হলেও পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের অগ্রদুত ছিলেন রামমোহন । পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং ইংরেজী জাতির উদারতার সংস্পর্শে কুসংস্কার গত ও সমাজব্যাবস্থার দ্রুত রুপান্তর ঘটানো ছিল রামমোহন এর ঐকান্তিক লক্ষ্য । হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠার সূচনা পর্বে এর সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন বলে মনে করা হয় । সম্ভবত রক্ষণশীল হিন্দুদের বিরোধিতার জন্য তিনি এর প্রস্তুতি কমিটি থেকে স্বেছায় ঘুরে গিয়েছিলেন ।

রামমোহন সম্ভবত সর্বপ্রথম ভারতীয় যিনি বিভিন্ন পাশ্চাত্য মতবাদ ও সমসাময়িক ইউরোপের রাজনৈতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে তোয়াকিবহুল ছিলেন । ফরাসী বিপ্লব ও আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল । এইসব ঘটনা তিনি মিরাৎ-উল-আকবর পত্রিকার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ভারতে সমাজ সংস্কারের অগ্রগতি দান করেছিলেন । সংস্কারকরূপে রামমোহন এর কর্মকাণ্ড ছিল বহু বিস্তৃত । বাক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা, কৃষকের রাজস্ব হ্রাস ইত্যাদি নানাদিকে তাঁর দৃষ্টি ছিল । ১৮২৩ খ্রীঃ প্রেস অর্ডিনারি জারি করে সংবাদপত্রকে কণ্ঠরোধ করতে চেষ্টা করলে রামমোহন তীব্র প্রতিবাদ জানায় ।

আধুনিক ভারতের পথিকৃৎ হিসেবে রামমোহন রায়ের অবদানের কথা সরবাঙ্গিকরণ করা হলেও বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও সীমাবদ্ধতা তাঁর কৃতিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন চিহ্নিত করে তোলে । প্রথমত ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক শোষণ সম্পর্কে তিনি অবৈধ ছিলেন কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কখনোই সোচ্চার হয়নি । দ্বিতিয়ত পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে তাঁর উদ্যোগের প্রভাব কম ছিল না কিন্তু নারী শিক্ষা বিস্তারে তিনি উদাসীন ছিলেন । এইসব সীমাবদ্ধ সত্ত্বেও রামমোহন এর অবদানকে অস্বীকার করা যায় না । ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ এবং পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদের ঘটানোর কাজ কঠিন ।

Leave a Comment

error: